বাংলা রচনা : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা

ভূমিকা : বাঙালি জাতির আকাঙ্ক্ষা, সক্ষমতা, গর্ব ও গৌরবের সম্মিলিত প্রয়াসে নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রকল্প ও সেতুর নাম পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বা পদ্মা বহুমুখী সেতু। সমগ্র দেশব্যাপী নানা উৎসব ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির গৌরবের প্রতীক পদ্মা বহুমুখী সেতুর শুভ উদ্বোধন করা হয় ২৫ জুন ২০২২। নানা ঘটনা-প্রবাহের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী পদ্মা বহুমুখী সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের সক্ষমতা ও সামর্থ্যের জানান দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশ্ব দরবারে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে এ সেতু বিপ্লব ঘটাবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত । পদ্মা সেতুর ফলে দেশের জিডিপির হার ১.২৩ শতাংশ এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। 

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকা : পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে। পদ্মা সেতু দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে ধরনের ভূমিকা রাখবে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো :

১. সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভর করে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের উপর। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হবে। এতে করে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে দেখা গেছে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু নির্মিত হলে ২০১৫ সাল থেকে ৩১ বছরের মধ্যে জিডিপি ৬০০০ মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩২ সালের পর বার্ষিক রিটার্ন ৩০০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে ।

২. আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ সহজ হবে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা সহজ হবে, যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই প্রয়োজন ।

৩. শিল্পায়ন বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শিল্পায়নের প্রাণ বলা হয়। কেননা কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য প্রয়োজন উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের শিল্প উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই । তাছাড়া ফরিদপুরে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ৪. কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন : কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন। পদ্মা সেতু পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতা কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন হবে । পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের কৃষির ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে ।

৫. অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন : পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, যা প্রকারান্তরে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ঘটিয়ে পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি করবে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর ।

৬. নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি : পদ্মা সেতু শিল্পায়ন, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও পরিবহন খাতের বিকাশ ঘটাবে। এতে করে ব্যাপক নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রায় দুই কোটি বেকারের কিছু সংখ্যক লোক কর্মসংস্থানের মুখ দেখবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের সুফল হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হবে এবং কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুসংবাদ ।

৭. দারিদ্র্য হ্রাস : এ সেতুর ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ০.৮৪% হারে দারিদ্র্য হ্রাস পাবে বলে দাতা সংস্থাগুলো আশা প্রকাশ করেছে । এর ফলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটবে।

৮. নদী ভাঙন রোধ : নদী তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে নদী তীরবর্তী ৯ হাজার হেক্টর জমি নদী ভাঙন থেকে রেহাই পাবে এবং বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাবে। এই জমির মূল্যমান প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ডলার ।

৯. সরকারি ব্যয় হ্রাস : ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে বর্তমানে সরকার ফেরি সার্ভিস চালু রেখেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ফলে ফেরি সার্ভিস বন্ধ হবে, আদায়কৃত পরিবহন টোলের অর্থ নিজ দেশেই থেকে যাবে। ফলে সরকারের বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পাবে যার মূল্যমান প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ডলার ।

১০. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখনও অবহেলিত। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যাই এ অবহেলাকে জিইয়ে রেখেছে। তাই বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা মতে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর ফলে অবহেলিত দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নের মুখ দেখবে।

১১. রপ্তানি বাণিজ্যের গতি বৃদ্ধি : ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের তুলনায় পায়রা সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটারের কম । ফলে পদ্মা সেতু আমদানি-রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

১২. বিনিয়োগ বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু দেশের বিনিয়োগ প্রবাহে যে গতি সঞ্চার করবে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতির পালে যে নতুন হাওয়া লাগবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সেতুর ফলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ রিটার্ন আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদগণ ।

১৩. পুঁজি প্রবাহ ও শ্রম স্থানান্তরের ভূমিকা বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু দেশের পুঁজি প্রবাহ ও শ্রম স্থানান্তর বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

১৪. সমুদ্র বন্দরের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা বৃদ্ধি : পদ্মা সেতু রাজধানী থেকে দুই বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা অতীব সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করে দিয়েছে। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি মংলা ও পায়রা বন্দর এবং দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

১৫. পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব বৃদ্ধি : এ সেতুর ফলে পর্যটকরা এ অঞ্চলের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হবে। ফলে পর্যটন খাতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে, যার প্রভাব পড়বে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ।

উপসংহার : সর্বোপরি, পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে সর্ববৃহৎ অবকাঠামো হিসেবে বাস্তবতার আলোয় উদ্ভাসিত । এ বাস্তবতা পদ্মার দু'পারের কোটি কোটি মানুষের জীবনধারায় নতুন গতি সঞ্চার করেছে। এ সেতু বদলে দিবে তাদের জীবন জীবিকা, মুক্ত করবে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নতুন গতি সঞ্চার করবে এ সেতু। এ সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার দৃঢ় ভিত্তিকে বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ সেতুকে ঘিরেই আবর্তিত হবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতি । অতএব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকার ভবিষ্যৎ গতিশক্তি পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব ও অহংকারের এক মূর্ত প্রতীক ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url